Thursday, October 30, 2014

ব্লগ বিষয়ক বিক্ষিপ্ত ভাবনা


Posted by Faruk Ahmed Roni on October 30, 2014 at 1:47pm in ফিচার

ব্লগ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বার বার আহতবোধ করছি। ব্লগ নিয়ে বাংলাদেশে বা বাঙালি মানসে যে বিতর্কের অবস্থান নিয়েছে সেটা রীতিমত অপরিহারযোগ্য একটি বিষয়। ব্লগ কি বা কেন? সে বিষয়টা যাদের কাছে এখনো পরিষ্কার না, তাদের জন্য ব্লগ বা ব্লগার মানে নাস্তিকতাবাদ! দুঃখের বিষয় হচ্ছে এটা কেবলমাত্র আমাদের বাংলাদেশেই সম্ভব হচ্ছে কারণ আমাদের ক্ষুদ্র মন-মানসিকতা, মুক্তচিন্তার অভাবই এমন একটি কঠিন অবস্থানের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আসলেই কি ব্লগ নিয়ে সচেতন?

২০০৫ সালের আগেও বাঙালি লেখক বা পাঠকের কাছে বস্নগ বা ব্লগার সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা ছিলনা। তাছাড়া ব্লগের আদর্শগত বা মৌলিক বিষয় নিয়ে আমাদের কখনও মাথাব্যথা বা জানার কোন সুযোগও হয়ে ওঠেনি। যদিও বস্নগের জন্মটা ছিল একানত্মই ইউনিভার্সিটিতে কিছু রিসার্চ কাজ বা গ্রুপ ফোরাম হিসাবে ওয়েবসাইটে একক বা গ্রুপের কাজগুলো প্রকাশের মাধ্যমে শেয়ার করা হতো। যাকে web log বলা হতো, যার উচ্চারণ (web log) হিসাবে প্রচলিত। ক্রমান্বয়ে তার সম্পাদিত রূপ নেয় নষড়ম হিসাবে এবং ওয়েবলগ্‌ সম্পাদনা করেন এবং লিখেন এমন লেখককেই বস্নগার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে আসছে। বস্নগ হচ্ছে নিজের কথা, মক্তচিন্তা বা ব্যক্তিগত মত প্রকাশের একটি মাধ্যম বলা যায়।- "In a sense who you are has always been a story that you told to yourself. Now your self is a story that you tell to others"

জাস্টিন হল সোয়ার্থমোর কলেজে অধ্যয়ন কালে ১৯৯৪ সালে তার নিজের লেখা বা জার্নাল ওয়েবলগ করার মাধ্যমে তার ব্লগার হিসাবে যাত্রা শুরু এবং তিনি আদি ব্লগাদের একজন হিসাবে বিবেচিত। তাছাড়াও ব্লগ লেখক হিসাবে ৯০-এর দশকের আরো কিছু পরিচিত weblogger দের মধ্যে ক্যামেরুন বারেট- এর ক্যামওয়ার্ল্ড, ১৯৯৮ সালে ব্রুস আবেলসন তার ওপেন ডায়রি প্রকাশনা, বা রেবেকা ব্লাড-এর যার যাত্রা শুরু হয় রেবেকাস্‌ পকেট নামে একক ব্লগ এবং ব্র্যাড ফিটজপ্যাট্রিক শুরু করেন তার লাইভ জার্নাল লেখার মাধ্যমে।

মূলত তারা বস্নগে (বিনষড়ম) নিজের লেখা প্রবন্ধ, বা পছন্দের বিভিন্ন বিষয় ও তাতে মনত্মব্য বা প্রতিনত্মব্য প্রকাশের সহজ মাধ্যম সংম্পৃক্তকরনের কারণেই একজন সাধারণ পাঠক বা লেখকের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। বস্নগকে সহজতরভাবে ব্যাখা করা যায়, যেমন-

“…the first journalistic model that actually harnesses rather than merely exploits the true democratic nature of the web. It’s a new medium finally finding a unique voice.”

২০০৫ সালে সর্বপ্রথম বাংলাবস্নগ হিসাবে বস্নগের আদর্শ নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে সামওয়্যারইনব্লগ। তারপর ২০০৭ সালে সচলায়তন, ২০০৮ সাথে প্রথম আলোবস্নগ ছাড়াও ধীরে ধীরে বাংলা ব্লগের জন্ম হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। প্রথম দিকে বাংলা বস্নগে লেখালেখি শুরু করেন এমন পরিচিত লেখক কবির সংখ্যা খুবই অল্প ছিলো কিন' তার বিসত্মার শুরম্ন হয় বলতে গেলে ২০০৮ সাল থেকে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখে বাংলা বস্নগ দিবসের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।

ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে যুদ্ধাপোরাধী কাদের মোলস্নার ফাঁসির রায়ের পক্ষে শাহবাগে আন্দোলনকে সামনে নিয়ে বাংলা বস্নগ বা বস্নগার সম্পর্কে রাতারাতি বাংলাদেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষসহ সাধারণ মানুষের কাছে নতুনমাত্রা যোগ হয়। যার ফলশ্রুতিতে গণজাগরন মঞ্চ বা প্রজন্ম চত্বরের অবতারণা যার উত্তোরন স্বাধীনতা ও প্রগতিশীলতার পক্ষের শক্তি হিসাবে। ঠিক সেই সময়ই আন্দোলনকারী বস্নগার রাজীব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বস্নগে লেখালেখির কারণে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন। রাজিবকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার অপশক্তির পক্ষপাতিত্বের বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যায় মানুষের কাছে। সেই মামলার অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তিতে বলা হয়, ইসলামধর্ম সম্পর্কে বস্নগে বাজে মনত্মব্য করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। যার সূত্রধরে লাইমলাইটে আসে হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি। যাদের দাবি বস্নগার মানে নাসিত্মক এবং তারা নাসিত্মক মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে বস্নগারদের বিরুদ্ধে ফাঁসির দাবি নিয়ে রাসত্মায় নেমে আসে। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল লোকজন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে এরকম একটি সংকটময় সময়ের জন্ম দিয়েছে যাতে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের নামে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। বস্নগের মত সুন্দর এবং স্বচ্ছ পস্নাটফর্ম এবং বস্নগারদের নিয়ে শুরু হয় বিবেকবর্ধিত সমালোচনার ঝড়। বস্নগারদের নাসিত্মক ও মুরতাদ আখ্যায়িত করার স্পর্ধা দেখাতে পেরেছে একমাত্র অল্পকিছু ধর্ম সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াশীল ব্লগারদের কারণে, যারা ধর্ম বিদ্বেষী কিছু কটূক্তির মাধ্যমে মুক্তচিনত্মাকে কাজে লাগিয়েছেন। সাথে সাথে তারা অবশ্যই ব্লগের মর্যাদাকেও ক্ষুন্ন করেছেন। কারণ ব্লগ মুক্তচিন্তার সুযোগ করে দিয়েছে ঠিকই কিন' কোন ধর্ম, বর্ণ, জাতি বিদ্বেষী কটাক্ষ করার সুযোগ শুধু বস্নগে কেন পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সমাজে এবং মানবাধিকার আইনেরও পরিপন্থী। একই ভাবে একক বা কোন ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে বস্নগারদের সরাসরি নাসিত্মক বা মুরতাদ অপবাদ দেয়া মারাত্মক রকমের মানবতা বিরোধী অপরাধ। অবশ্যই মনে রাখতে হবে আজকে যারা ফেইসবুক ব্যবহারকারী তারাও ব্লগার, সেড়্গেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের দেয়া ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আপনিও একজন নাস্তিক! তাই ফতোয়া দেয়ার আগে জেনে নিন আপনার পরিবারে কতজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী, আপনার এবং আপনার সংগঠনের কার্যকলাপ কতটা ব্লগে প্রকাশ এবং প্রচারিত হচ্ছে। বস্নগে যেমন রয়েছে মুক্তচিনত্মা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপক সুযোগ তেমনি প্রতিটি বস্নগের নীতিগত কিছু কাঠামো রয়েছে, তাছাড়াও সার্বিকভাবে বস্নগের যথারীতি নিয়মতান্ত্রিক আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। তাই ব্লগারদের সেক্ষেত্রে সব সময় নিশ্চিত থাকা বাঞ্ছনীয়।

গোটা বিশ্বের প্রচার এবং প্রকাশনা মাধ্যম এখন হাতের আঙুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ডায়রি বা জার্নাল প্রকাশনার মাধ্যম হিসাবে যে ব্লগের জন্ম হয়েছিল সেটাই আজ চরম বাসত্মবতা নিয়ে আমাদের সামনে ফেইসবুক বা টুইটারে প্রতিফলিত। আজ ফেইসবুকে বা টুইটারে প্রতিদিন যে পরিমান স্ট্যাটাস আসে তার বেশিরভাগই আমাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি বা সামাজিক অবস্থান এবং কর্মতৎপরতা নিয়েই প্রকাশ হয়ে হয়ে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবনে নানা রকম প্রভাবও ফেলছে। তাছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে ব্লগিং মানুষের মসিত্মস্কের ক্লান্তি, বিষণ্নতা এবং হতাশা মুক্তির জন্য যথেষ্ট সহায়ক। অনেকের মতে শরীরের উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধোক হিসাবেও সাহায্য করে, যেমন প্রাশ্চাত্যের একজন লেখক ব্লগিং সর্ম্পকে লিখতে গিয়ে বলেন;

"During my difficult time, blogging allowed me to connect with people in ways that lifted me out of the darkness. And I found that the act of blogging lowered my blood pressure during a very stressful period. Writing every day was an important part of healing both my mind and body."

আমার বিশ্বাস এতে কোন রকম সন্ধেহ নেই। মুলত আজকের এই গ্লোবালাইজ জীবনে পৃথিবীর যে কোন দেশের একানত্মই নুন্যতম শিক্ষিত মানুষও ব্লগের প্রতি দুর্বল, কমবেশি সবাই লিখতে চেষ্টা করছে এবং সবাই বস্নগার হিসাবে দাবী রাখতে পারে। বস্নগিং আত্মতৃপ্তি শুধু নয় আত্মজ্ঞানেও পরিশুদ্ধ্‌ করতে সহায়ক।

সাথে সাথে বস্নগ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ এবং সর্বশেষ নেটওয়ার্কিং মার্কেটিং প্রন্থা‌ও বলা যেতে পারে, যার মাধ্যমে কোটী কোটী পাউন্ড ডলার আয়ের সোর্স হিসাবে কাজ করছে ইন্টারনেট সার্ভিসগুলো, যেমন গুগল, ফেইসবুক, টুইটার ইত্যাদি সর্বচ্চ অর্থনেতিক মুনাফা লুফে নিচ্ছে আর তা কেবলই সম্ভব হচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের ব্লগিং এর মাধ্যমে। এরকম প্রতিদিনই বস্নগিং থেকে এক শ্রেনীর ছোট ছোট ব্যবসায়ীরাও অর্থনৈতিক ভাবে সহজভাবে লাভবান হচ্ছে। একসময় নেটওয়ার্কিং মার্কেটিংকে সোশ্যাল এবং মানবিকশক্তির সাইকোপ্যাথপ্রযুক্তি হিসাবে সহজভাবে উপার্জনের একটি উত্তমপন'া বিবেচিত হয়েছিল, যাকে আমরা ফরমুলায় যদি বলি: One percent of 100 people's efforts are better than 100 percent of your own effort. অর্থাৎ একজনের শতভাগ প্রচেষ্টা বা পরিশ্রমের বদলে শতভাগ লোকের এক একভাগ প্রচেষ্টায় লাভবান হবার যে পদ্ধতি সেটা ব্যবহৃত হচ্ছে ইন্টারনেটের আয়ের উৎস হিসাবে। যেমন ফেইসবুক, গুগুল, মাইপেস্নস বা টুইটারের মত বস্নগ পস্নাটফর্মগুলোতে আমাদের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ তাদের রাতারাতি আকাশছুঁয়া বাণিজ্যের পাহাড় করে তুলছে।

অবশ্যই আমরাও প্রত্যেকেই ব্লগিং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারি কিন্ত সেটা কেমন করে, বিষয়টি কেবলমাত্র জানার অপেক্ষা মাত্র। যাহা নিয়ে আমরা না ভাবলেও পশ্চিমা দেশগুলো ঠিকই অর্থনৈতিক ভাবেও সুযোগ সুবিধা নিতে পারছে।

বাংলাদেশে বস্নগকে যতটাই আমরা বির্তকিত করিনা কেন, ব্লগ হচ্ছে মুনত্মচিন্তা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুধু নয়, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে এবং সাথে সাথে অর্থনৈতিক মুক্তির পথেও একটি যুগপযোগী বিপ্লব বলা যেতে পারে।

আসুন আমরা ব্লগকে সৃজনশীল ও প্রগতির মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করি এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে প্রতিহত করি, যারা ব্লগ এবং ব্লগারদের নিয়ে বির্তকের পথে অবস'ান নিচ্ছে। সবশেষে আমার একটি মাত্র প্রত্যাশা বস্নগ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নান্দনিক পস্নাটফর্ম হিসাবে কাজ করুক, ব্লগ মানুষের প্রতিদিনের চিন্তাশক্তি ও বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করুক।

জয় হোক ব্লগ ও ব্লগবাসীদের ।

No comments:

Post a Comment